৫০০ বোতল পানি বিক্রি করে ৪০০ বোতলের রাজস্ব আত্মসাৎ করলে কি শাস্তি হবে : সামসুদ্দীন চৌধুরী

অবৈধ ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে রেল পানির টেন্ডার হাতিয়ে নিল শ্যামলী পরিবহন

Passenger Voice    |    ০৯:৫৯ এএম, ২০২০-১০-০৬


অবৈধ ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে রেল পানির টেন্ডার হাতিয়ে নিল শ্যামলী পরিবহন

নিজস্ব প্রতিবেদক: অবৈধ ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে রেলকে কুক্ষিগত করে বাজার দরের বেশি মুল্য আদায় করে রেল অঙ্গনে একচেটিয়া ব্যবসা করে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের লক্ষে অনৈতিক সুবিধার মাধ্যমে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের সাথে রেল পানির নামে অনৈতিক চুক্তি করার অভিযোগ উঠেছে  শ্যামলী ফুড এন্ড বেভারেজ প্রাইভেট লিমিটেডের বিরুদ্ধে। এই চুক্তির বাস্তবায়ন হলে  একদিকে যেমন যাত্রী অধিকার লংঘিত হবে অন্যদিকে চরমভাবে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বে বাংলাদেশ রেলওয়ে।

২০১৯ সালের ৪ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সব সরকারি দপ্তরে দেশের প্রতিবন্ধীদের দ্বারা তৈরি ‘মুক্তা ন্যাচারাল ড্রিংকিং ওয়াটার ব্যবহারে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য একটি নির্দেশনা দেয়া হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের শাখা-১ (প্রশাসন) এর সহকারী সচিব মো. সামীম আহসান স্বাক্ষরিত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে বলা হয়, ‘প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত শারীরিক প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট, মৈত্রী শিল্প, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক পরিবেশিত ও বোতলজাতকৃত ‘মুক্তা ন্যাচারাল ড্রিংকিং ওয়াটার’ সকল সরকারি দপ্তরে পরিবেশন/ব্যবহারে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়। এমনকি বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবসে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও প্রতিবন্ধীদের তৈরি ‘মুক্তা পানি’ সবাইকে কিনতে বলেছেন। তবে সরকারপ্রধানের এ সব নির্দেশনা অনুরোধের কোন তোয়াক্কা না করেই চলতি বছরের ১৩ আগস্ট নিজস্ব ব্রান্ডের পানি সরবরাহের নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এদিকে  দেশের প্রতিবন্ধী দ্বারা উৎপাদিত 'মুক্তা পানি' ব্যবহারে অগ্রাধিকার না দিয়ে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি করাকে রেলওয়ের আত্মঘাতী বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা। 

রেলওয়ে ও শ্যামলীর চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশ রেলওয়ে রয়েলিটি হিসেবে ৫০০ গ্রাম পানির বোতল প্রতি ১ টাকা ৪০ পয়সা ও ১ লিটার পানির বোতল প্রতি ১ টাকা ৫০ পয়সা প্রদান করবে শ্যামলী ফুড এন্ড বেভারেজ প্রাইভেট লিমিটেড। তবে এই টাকাটা পুরোই যাত্রী সাধারণের পকেট কেটে। বর্তমান বাজার মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত আদায় করা হবে।  এই চুক্তিতে আরো বলা হয়েছে শ্যামলী ফুড এন্ড বেভারেজ প্রাইভেট লিমিটেডের বিক্রয় কর্মীরা বিশেষ পাশ বা পরিচয়পত্রের মাধ্যমে বিনা ভাড়ায় ট্রেনে যাতায়াত করতে পারবে যার সংখ্যা সর্বনিম্ন ১৫ জন তবে সর্বোচ্চ কতজন যেতে পারবে তার সংখ্যা উল্লেখ নেই। আরেকটি শর্তে উল্লেখ করা হয়েছে বিশেষ বিবেচনায় ক্ষেত্র বিশেষ শ্যামলীর উৎপাদিত রেল পানি বিনা ভাড়ায়  অর্থাৎ এফএস পদ্ধতিতে বিভিন্ন স্টেশনে পৌছানোর সুযোগ থাকবে।

অন্যদিকে রেলওয়ে সুত্রে জানা গেছে বিনা ভাড়ায় ট্রেনে যাতায়াত করার কোন সুযোগ নেই যারা ক্যাটারিং পরিচালনা করে তারাও দুরত্ব হিসেবে নির্ধারিত ভাড়া প্রদান করে থাকেন। এই ক্ষেত্রে শ্যামলীর জন্য সুযোগটি সম্পুর্ন অনৈতিক।

এই বিষয়ে রেলপথ মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, এই চুক্তির মাধ্যমে তো কোন নিয়ম ভঙ্গ করা হয়নি।  তারা ( মুক্তা পানি ) যদি রেলের সাথে যুক্ত হতে আগ্রহী থাকে তারাও আসতে পারে, এতে কোন সমস্যা নাই। আমরা এর নাম দিয়েছি ‘ রেল পানি ‘। এই নাম দিয়ে তাদের ( বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ) লোক রেলে পানি সরবরাহ করবে। এটাতে রেলের ব্রেন্ডিং হবে, এতে আমাদের রেল মানুষের কাছে আরও জনপ্রিয় হবে।

এব্যপারে ক্ষোভ প্রকাশ করে যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মোঃ সামসুদ্দিন চৌধুরী প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, গত বছরেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রতিবন্ধীদের উৎপাদিত মুক্তা পানি সকল সরকারী দপ্তরে ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন,  রেল কর্তৃপক্ষ এই আদেশকে উপেক্ষা করে শ্যামলীর সাথে চুক্তি করে প্রতিবন্ধীদের প্রতি অন্যায় করেছে। আর তাদের বিক্রয়কর্মী ও পণ্য ফ্রিতে বহন করা আরো অন্যায়, রেল কর্তৃপক্ষ চাইলে তাদের নুন্যতম একটি ভাড়া নির্ধারন করে দিতে পারতো কিন্তু তা না করে ফ্রি সার্র্ভিসের নামে রেলকে বছরে কয়েক কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতির মুখে ফেলছে। এই সিস্টেমের বিপরীতে তারা অন্যভাবে শ্যামলীর কাছ থেকে অনৈতিক কোন সুযোগ সুবিধা নিচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করেন তিনি। রেলওয়ে আইন অনুযায়ী একজন মন্ত্রীও যদি ট্রেনে ভ্রমন করেন তিনি যাত্রী ভাড়া পরিশোধ করতে হয়। রেল পানি বিক্রির ক্ষেত্রে শ্যমলীতো ব্যবসা করবে নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক স্টাফদের টিএ ডিএ বিল দেওয়া হবে। তাছাড়া প্রতিটি কোম্পানি উৎপাদিত পণ্য নিজ খরচে ডিলারদের কাছে পৌছে দিয়ে থাকে এখানে শ্যামলীর পণ্য  এবং স্টাফ ফ্রিতে আনা নেওয়ার দায়িত্ব রেলকে কেন নিতে হলো তা বুঝলামনা। এছাড়া রেল কত বোতল পানি রেলে বিক্রি করবে সে হিসাবটা রেলওয়ে কিভাবে পাবে সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলা নেই। তাহলে ৫০০ বোতল পানি বিক্রি করে রেলকে ১০০ বোতলের হিসাব দিয়ে ৪০০ বোতলের সরকারের রাজস্ব আত্মসাৎ করার চেষ্টা করলে শ্যামলীর শাস্তি কি হবে সেটাও  চুক্তিতে বলা হয়নি।

শ্যামলী ফুড এন্ড বেভারেজ প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রমেশ চন্দ্র ঘোষ প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, আমরা অনৈতিক কোন প্রভাব খাতিয়ে টেন্ডার গ্রহন করিনি। রেলওয়ে টেন্ডার আহব্বান করেছে আমরা টেন্ডার পেয়েছি। মুক্তা পানি টেন্ডারের আবেদন নিয়েছিল কিন্তু তারা জমা দেয়নি। 

আড়ও পড়ুন >>>>>>>>>>>>>> রেলের কেনাকাটায় হরিলুট: কব্জির জোরে বহাল দুর্নীতিবাজরা

এদিকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত ‘মুক্তা পানি’ মিনারেল ওয়াটারের বোতল দেশের প্রতিবন্ধীরা তৈরি করছে। এর কারখানা গাজীপুরে। এর বিশেষত্ব হল এই কারখানাটি সম্পূর্ণভাবে প্রতিবন্ধীদের দ্বারা চলে। এখান থেকে যে লাভ হয় তার পুরো অংশই প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে ব্যয় করা হয়।

এদিকে এই চুক্তির পর থেকে বিষয়টি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করছে নেট জনতা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে মীর আজিজুল হক নামের এক আইডি থেকে বলা হয় 'গত ১লা অক্টোবর থেকে সকল রেলস্টেশনের প্লাটফর্মের লাইসেন্স প্রাপ্ত দোকানে শুধু রেল পানি বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয় রেলওয়ে। এর মাধ্যমে রেল কর্তৃপক্ষ তাদের লোকসানের পরিমাণ কম করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এখানে উল্লেখ্য এই রেল পানির প্রস্তুতকারক শ্যামলী ফুড এন্ড ভেবারেজ লি.। শ্যামলী পানি তাদের নিজেদের বাস শ্যামলী পরিবহন ছাড়া তেমন কোথাও চোখে পরে না। তাই এর মান নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। শ্যামলীর পরিবর্তে সরকারের মুক্তা পানি, যেটা প্রতিবন্ধীরা তৈরি করে, এমনকি রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর অফিসে ও বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে এই পানিটি ব্যবহার করা হয়। কোন স্বাভাবিক, সুস্থ মানুষকে এখানে কাজ দেওয়া হয় নি। আর এখান থেকে যে লাভ হয় তার পুরো অংশই প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে ব্যয় করা হয়। সরকারি হাই লেভেলের মিটিং ও প্রোগ্রামগুলোতে এ পানি ব্যবহার করা হয়। সহজেই বুঝা যায় এটি কেমন বিশুদ্ধ হতে পারে অথচ দাম একই। কোন বিজ্ঞাপন না থাকার কারণে এর প্রসার ঘটছেনা। প্রসারের জন্য প্রতি জেলায় জেলায় ডিলারও দরকার রয়েছে। এক বোতল পানি কিনেও যদি এই পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর উপকার করা সম্ভব। সরকারি সেই মুক্তা পানিকে আরেকটি সরকারি প্রতিষ্ঠান রেলওয়ে কি প্রমোট করতে পারত না? একদিকে রেলওয়ে তাদের লস কমাতে পারতো অন্যদিকে প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নেও অবদান রাখতে পারতো। নাকি এখানে ও দুর্নীতিবাজদের পকেট ভারী করার জন্য শ্যামলির সাথে চুক্তি করা হয়েছে। আশাকরি রেলের কর্তারা বিষয় টা নিয়ে আবারও ভাববেন।'

বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়েতে ভ্রমণরত যাত্রীদের খাদ্যদ্রব্য সরবরাহের জন্য রেলের নিজস্ব ক্যাটারিং সার্ভিস চালু রয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন রেল যদি ' মুক্তা পানির ' সঙ্গে চুক্তি করতো তাহলে যেমন রেলের রাজস্ব আয় হত তেমনি দেশের প্রতিবন্ধীদের কল্যাণের জন্য নতুন একটি আয়ের উৎস পাওয়া যেতো এমনকি প্রতিভাবান প্রতিবন্ধীরাও তাদের প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে আরো অনুপ্রাণিত হতো যেমনটা প্রধানমন্ত্রী এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন 'অটিস্টিকদের মধ্যে সুপ্ত প্রতিভা রয়েছে, নিজেদের প্রতিভা দিয়ে এরা অনেক কিছু তৈরি করতে পারে।’ প্রধানমন্ত্রী ওই অনুষ্ঠানে ‘মুক্তা পানি’ মিনারেল ওয়াটারের বোতল হাতে নিয়ে সবাইকে দেখিয়ে বলেছিলেন, 'এটি কিন্তু আমাদের প্রতিবন্ধীরাই তৈরি করছে। এতো সুন্দর পানি, এতো সুন্দর বোতল।’ এসময় এই পানি কেনার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান তিনি।